যে ব্যাপারটি খুব ধীর গতিতে লোকচক্ষুর অন্তরালে চট করে হারিয়ে গেলো সেটি হচ্ছে এই ডেসপোটিক সরকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করেছে।
হেলমেট, লুঙ্গি আর পুলিশ ওয়ালারা সাত সকালে ইস্ট ওয়েস্ট, ব্রাক, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে আচমকা আক্রমন করে এবং ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে ঢুকে ছাত্রদের দিকে শর্টগান, টিয়ারসেল এগুলো নিক্ষেপ করে। কেন করে, কি উদ্দেশ্যে করে কিংবা কারনই বা কি ছিলো আমরা তা জানতে পারি নাই।
এই আক্রমনের রিভারবিরেশনে ছাত্ররা নিজেদের রক্ষা করার জন্য ইট পাটকেল ছোঁড়ে। যার ফলাফল দাঁড়ায় পরবর্তী তিনদিন ধরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা কিংবা ইউনিভার্সিটি সংলগ্ন এলাকাতে ব্লক রেইড দিয়ে সরকারী পুলিশ সংস্থা এই ছাত্রদের গণ গ্রেফতার করে।
আমরা এও জানতে পেরেছি যে গ্রেফতারের পর এই ছেলেদের অমানুষিক টর্চার করা হয় এবং এদেরকে কোর্টে চালান দিয়ে রিমান্ডের আবেদন করা হয়। নিম্ন আদালতে এই ছেলেগুলোর রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর হয়।
এই অথরেটেরিয়ান সরকার এই নবীন-তরুন শিক্ষার্থীদের একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছে। আরো বড় আকারে বলা যেতে পারে এই ২২ জনকে তুলে নিয়ে যাবার পেছনে একটা উদাহরন তৈরীরও প্রয়াস রয়েছে।
প্রশ্ন আসতে পারে, কি উদাহরন?
উত্তর হচ্ছে, ক্ষমতা দেখাবার। প্রতিশোধ নেবার এবং একটা স্যাম্পল পিক করে অন্যদের জন্য শক্ত বার্তা পৌঁছে দেওয়া যে, “দেখো, সরকারের দিকে আর নজর দিওনা। সরকারের বিরুদ্ধে আর নেমোনা।”
এই ছাত্ররা যে গ্রেফতার হয়েছে এগুলোর সূত্র খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় তাদেরই অনেক সহপাঠী এই ডেস্পোটিক সরকারের সহযোগী। অনেকটা রাজাকার-আলবদরদের মত এরা আইন শৃংখলাবাহিনীদের নানাবিধ তথ্য দিয়েছে এবং সরকার এই পদ্ধতিতে গ্রেফতারের একটা ফ্রেম সাজিয়েছে। যদিও এই রাজাকারের সংখ্যা খুবই সামান্য।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে ছাত্রদের গ্রেফতার করা হয়েছে এদের অপরাধ কি?
এই বিষয়ে স্বাভাবিক উত্তর হচ্ছে, কোনো অপরাধ নেই। শুধু মাত্র একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরী করা এবং রাষ্ট্রকে এই বার্তা পৌঁছে দেয়া যে, আমরা এখানে আজীবন রুল করতে এসেছি। ২২টা, ৪২ টা কিংবা একশ প্রাণ এখানে নস্যি। দরকার হলে কয়েকলক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, মামলার বিনিময়ে এই সরকার টিকে থাকবে।
এই যে গলা চাপ দিয়ে এভাবে গ্রেফতার, এইভাবে খুন, হত্যা আর গুমের একটা দেশ হয়ে উঠেছে, এটির পরবর্তী প্রতিক্রিয়া এই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে কেন অত্যন্ত শূন্য?
আমার ভাবনায় বার বার কাজ করছিলো এই গণ গ্রেফতারের পরবর্তীতে ছাত্ররা কেন এর প্রতিবাদে ক্লাস বর্জন করেনি, কেন তারা সকল রকমের পরীক্ষা, সকল রকমের শিক্ষা কার্যক্রম স্টপ করে বাসায় ফিরে যায়নি। ছাত্রদের এই অহিংস প্রতিবাদ হতে পারত খুব তাৎপর্যপূর্ণ কিছু। কিন্তু দুঃখের কথা হচ্ছে, এটি হয়নি।
তবে আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি। হয়নি বলেই যে হবে না। এমন একেবারেই নয়।
প্রিয় কবি আবুল হাসান বলে গিয়েছিলেন,
“ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো,
ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও”
ঠিক তেমন করে আমার মনে হয়, এই উৎপীড়ন, এই নিপীড়ন এই দুঃশাষনের যে আফটারমাথ, সেটা প্রকারন্তরে ভয়াবহ। ছাত্ররা মুখ বুঁজে সয়ে গেলেও এরা কিন্তু মুখ দিয়ে আর “নৌকা” ফলাবে না। এরা মুখ দিয়ে এইবার লাভা ছড়াবে।
দশকের পর দশক রোড এক্সিডেন্টে মানুষ হত্যা হবার পরে কি সব সময় গণমানুষ রাস্তায় নেমেছে? উত্তর হচ্ছে, না নামেনি।
শত যন্ত্রণা আর দুঃখে নেমেছে এই ২০১৮ তে। আর তাতেই গদি টলমল করে দিয়েছে দূর্দান্তভাবে। ঠিক একইভাবে এই ২২ ছাত্র গ্রেফতার আর তার ফলশ্রুতির ক্রোধ ঠিকি ছাত্রদের বুকে গেঁথে গেছে। এদের ভেতরে আগুন জমা হচ্ছে। এদের ভেতর জমা হচ্ছে এই ডেস্পোটিক সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা।
আমি নিশ্চিত, একদিন এইসব ঘৃণা ছড়িয়ে পড়বে নগরে, রাস্তায়, এভিনিউতে, আকাশে, পাহাড়ে সবখানে। একদিন সব বাঁধ ভেঙ্গে যাবে এই তীব্র প্রাণসম্পন্ন ছাত্রদের শরীর থেকে। সেদিন তাঁরা বুঝিয়ে দেবে, অন্যায়, অত্যাচারের উত্তর কেমন হতে পারে।
ঠিক যেমন ক্ষুদে কিশোর কিশোরীরা গাড়ির কাঁচে টোকা দিয়ে বলেছিলো, “লাইসেন্স আছে?”
এই বাংলাদেশে যতগুলো সফল ও আলোড়িত আন্দোলন হয়েছে, সব করেছে ছাত্ররা। ইতিহাসের টাইমলাইন সেটিই বলে। এই সুরকার যেভাবে তাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই কিশোর থেকে যুবক সবাইকেই উন্মক্ত করে তুলছে, ফলে বিষ্ফোরণ হতে খুব বেশী সময় লাগবে বলে আমার মনে হয়না।
আমি অত্যন্ত ব্যাথিত ও দুঃখিত। আমি অত্যন্ত বিষাদ্গ্রস্থ এবং কষ্টে নিমজ্জিত।
বঙ্গবন্ধুর গড়া দলটির এই সময়ের নির্লজ্জতা পৃথিবীর অনেক একনায়ককে হার মানিয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে।
একটি রাষ্ট্র কি করে মানুষের মুখ চাপ দিয়ে ধরে এগুচ্ছে, কি করে নির্যাতন আর ভয়াবহ যন্ত্রণা দিয়ে মানুষকে “পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন”-এর দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমি বিষ্ময় নিয়ে প্রতিদিন দেখি।
আমি এই নিপীড়নের শেষ যাত্রা দেখবার জন্য অধীর আগ্রহে বসে রয়েছি।