পাম অয়েল রপ্তানি নিষিদ্ধ করে বেশ বিপাকেই পড়েছে ইন্দোনেশীয় সরকার! রপ্তানি আয় কমে গেছে, মজুত সক্ষমতাও পূরণ হওয়ার পথে। তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই স্থানীয় বাজারে পাম ফলের দাম নেমে গেছে প্রায় অর্ধেকে। হঠাৎ উপার্জনে ধস নামায় মাথায় হাত দেশটির পাম চাষিদের। তারা যত দ্রুত সম্ভব পাম অয়েলে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
স্থানীয় বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণের কথা বলে গত এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পাম অয়েল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। কিন্তু তার এ সিদ্ধান্ত বাজার স্থিতিশীল করার বদলে স্থানীয় পাম চাষিদের জন্য নতুন বিপদ ডেকে এনেছে। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকজন পাম চাষির সঙ্গে কথা বলেছিল কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। তাদের প্রায় প্রত্যেকেই রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন। জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য ইন্দোনেশীয় চাষিদের সেই বক্তব্যের সারাংশ তুলে ধরা হলো-
মানসুয়েতুস দার্তো, ইন্দোনেশিয়ান অয়েল পাম ফার্মার্স ইউনিয়নের প্রধান, পশ্চিম জাভা:
ক্ষুদ্র চাষিদের ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। কারণ তাদের অনেকেরই আয়ের অন্য কোনো উৎস নেই। অনেক চাষি কষ্ট করেছে, বিশেষ করে গত দুই বছর। তারা আশা করেছিল, মহামারির পরে হয়তো পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। তবে স্থানীয় বা বিশ্ব রাজনীতিতে কোনো সমস্যা হলে সেটি তাদেরও প্রভাবিত করে। ২০২০ সাল থেকে সবাই সংগ্রাম করেছে এবং এখন একটি নতুন সমস্যা হাজির হয়েছে।
জোকো উইদোদো দেশে একটি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন, বিশেষ করে ঈদুল ফিতরের ছুটির সময়, যখন খাদ্যদ্রব্যের দাম সাধারণত প্রতি বছরই বেড়ে যায়। যেহেতু কয়েক মাস ধরে রান্নার তেলের দাম বাড়ছে, তাই তিনি ভেবেছিলেন, সবচেয়ে ভালো কাজ হবে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা। কিন্তু মূল্য স্থিতিশীল করতে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়, তা আমরা অবিলম্বে দেখতে পেয়েছি। যেমন- দুর্নীতির কারণে দেশে অবৈধ রপ্তানির ঘটনা ঘটছে।
কৃষকদের জন্য হতাশাজনক বিষয় হচ্ছে, তাদের এখন সস্তায় তাজা ফল বিক্রি করে এরপর চড়া দামে রান্নার তেল কিনতে হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায় পাম অয়েল কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য বন্ধ করতে আমাদের আরও শোধনাগার দরকার।
ভ্যালেনস অ্যান্ডি, ফার্মার্স হোপ অয়েল পাম প্ল্যান্টেশন কোঅপারেটিভের প্রধান, পশ্চিম কালিমান্তান:
দামের এই পরিবর্তনে চাষিদের জন্য পরিস্থিতি ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। অনেকে মনে করছেন, তাজা ফলের দাম কমে যাওয়া এবং সার ও কীটনাশকের দাম ১০০ শতাংশের বেশি বেড়ে যাওয়ায় তাদের রোজগার ৫০ শতাংশ কমে গেছে।
পাম চাষিরা সাধারণত রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন এবং এর উপাদানগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করে এখানে মেশানো হয়। কিন্তু আমাদের সার সরবরাহকারীরা বলেছে, কাঁচামাল পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে, যে কারণে দাম বেড়েছে। আমরা আশা করি, তাজা পাম ফলের দাম স্থিতিশীল এবং প্রতিটি প্রদেশে ন্যূনতম মজুরির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, সব চাষিই উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছেন।
ইওয়ান হিমাওয়ান, পাম চাষি, পূর্ব কালিমান্তান:
রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার প্রভাব আমরা সত্যিই অনুভব করছি। জোকো উইদোদো গত ২২ এপ্রিল ঘোষণা দেওয়ার পরপরই পামের দাম কমে যায়। এমনকি ২৮ এপ্রিল নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার আগেই এ ধারা শুরু হয়ে যায় এবং পরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।
পূর্ব কালিমান্তানে আমরা আগে প্রতি কেজি পাম ফলের জন্য তিন হাজার ইন্দোনেশীয় রুপিয়া (প্রায় ১৮ টাকা) পেতাম। কিন্তু এখন দাম ১ হাজার ৭০০ রুপিয়ায় (প্রায় ১০ টাকা) নেমে গেছে। পূর্ব কালিমন্তানের গভর্নর একটি চিঠি দিয়েছিলেন যে, কারখানাগুলো যেন পাম ফলের দাম আর না কমায়। কিন্তু অনেকেই সেটি অগ্রাহ্য করেছে। কারণ তারা মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে পাম ফল কিনছে।
ইউসরো ফাদলি, পাম চাষি, রিয়াউ:
আমি আগে প্রতি কেজি পাম ফল ৩ হাজার ৯০০ রুপিয়াতে (প্রায় ২৩ টাকা) বিক্রি করতাম। এখন পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে দাম কমে ১ হাজার ৮০০ রুপিয়াতে (প্রায় ১১ টাকা) দাঁড়িয়েছে। অথচ পাম ফলের সরকার নির্ধারিত মূল্য হলো প্রতি কেজি ২ হাজার ৯৪৭ রুপিয়া (প্রায় ১৮ টাকা)।
কারখানাগুলো কী পরিমাণ তাজা পাম ফল কিনবে তা এখনো নির্ধারণ করেনি। তবে কারখানার বাইরে চাষিদের দীর্ঘ লাইন রয়েছে। কারণ তাদের আশঙ্কা, দাম আরও কমে যেতে পারে এবং সে জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেগুলো বিক্রি করতে চান।
সারের দাম ৩০০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের গাছপালার যত্ন ঠিকভাবে নিতে পারছি না। কিন্তু কেন এমন হলো সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। আগে ৫০ কেজি সারের জন্য তিন লাখ রুপিয়া (১ হাজার ৭৯১ টাকা প্রায়) খরচ হতো। কিন্তু এখন এর দাম ১০ লাখ রুপিয়ার (৫ হাজার ৯৬৯ টাকা প্রায়) বেশি। পাম ফলের দাম কমলে আর সারের দাম বাড়তে থাকলে এমন ক্ষুদ্র চাষি কোথায় পাবেন, যিনি ক্ষেতের যত্ন নিতে পারবেন?
আলবার্টাস ওয়াওয়ান, পাম চাষি, পশ্চিম কালিমান্তান:
পরিচালনা খরচই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কীটনাশক ও সারের দাম এখন আর আমাদের মুনাফার সমান নয়। পশ্চিম কালিমন্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকায় তাজা ফলের জন্য আমরা প্রতি কেজিতে প্রায় চার হাজার রুপিয়া (প্রায় ২৪ টাকা) পেতাম। কিন্তু এখন দাম প্রায় দুই হাজার রুপিয়ায় (প্রায় ১২ টাকা) নেমে গেছে। আমরা পাম ফলের দাম নিয়ে বড় চুক্তি করতে চাই না, আমরা কেবল চাই, এটি ন্যায্য হোক।
ইন্দোনেশিয়ায় ২৭ কোটি মানুষ এবং ১ কোটি ৬০ লাখ ক্ষুদ্র পাম চাষি এই নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমাদের জীবিকার ক্ষতি করে নিষেধাজ্ঞাকে বাজারের ‘শক থেরাপি’ করবেন না। আমাদের আশা, পাম ফলের দাম আবার বাড়বে। কিন্তু চাষিদের ধৈর্যের সীমা রয়েছে। তারা হয়তো আর ফসল তুলতে চাইবেন না। এছাড়া নিষেধাজ্ঞা আরও বেশি দিন থাকলে তা সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করবে। মানুষ কীভাবে তাদের দৈনন্দিন খরচ মেটাবে? তারা কীভাবে সন্তানদের স্কুলে পাঠাবে? কীভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনবে?
ভিনসেন্টিয়াস হারিওনো, পাম চাষি, জাম্বি:
নিষেধাজ্ঞার আগে আমরা প্রতি কেজি পাম ফল ৩ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার ৮০০ রুপিয়ায় (২১ থেকে ২৩ টাকা প্রায়) বিক্রি করতাম। এখন দাম প্রতি কেজি ২ হাজার ২১০ রুপিয়ায় (প্রায় ১৩ টাকা) নেমে গেছে।
আমি ক্ষুদ্র কৃষকদের ওপর নিষেধাজ্ঞার মানসিক প্রভাব সম্পর্কে বলতে চাই। আমরা খুব হতাশ বোধ করছি এবং চাষিদের কথা না ভাবায় অবশ্যই সরকারকে দোষারোপ করছি। সরকার আমাদের সঙ্গে কেন এমন করলো? মনে হচ্ছে, আমরাই রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছি। অভ্যন্তরীণ সরবরাহ স্থিতিশীল করতে এক সপ্তাহের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞাই যথেষ্ট হওয়া উচিত ছিল।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাম অয়েল কোম্পানিগুলো রান্নার তেলের স্থানীয় চাহিদার পুরোটা অথবা কমপক্ষে ৭০ শতাংশ পূরণ করতে পারে। অভ্যন্তরীণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত প্রথমে এগুলোর দিকে নজর দেওয়া এবং বেসরকারি খাতকে স্পর্শ না করা। আসুন, আমাদের পাম ফল বিক্রি করতে দেন এবং যেসব প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত পাম অয়েলসহ অন্যান্য পাম পণ্য রপ্তানি করতে চায়, তাদের তা করতে দেন।