“মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি আমরা। কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না, আমরা বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবই,” দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া দলটির বর্তমান নেতা।
টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের দুই বছর পূর্তিতে মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে একথা বলেন ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ দেশে উন্নীত করার লক্ষ্য স্থির করা শেখ হাসিনা।
গত সাত বছরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি তুলে ধরার পাশাপাশি সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আরও কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি; হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার কোনো চেষ্টা সহ্য না করারও।
ভিন্নমত ‘দলনের’ যে অভিযোগ বিএনপি করে আসছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। তিনি বলেছেন, এখন সরকারের সমালোচনা করা যাচ্ছে ‘স্বাধীনভাবে’।
বিএনপির বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় থেকে যায় আওয়ামী লীগ। ভোটের এক সপ্তাহ পর তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ হাসিনা।
তার দুই বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধুর পথ পেরিয়ে আসার কথা বলেন।
“বিএনপি-জামাতের দুঃশাসন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস এবং পরের দুই বছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দমননীতির ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল বিপর্যস্ত, বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। আমরা দায়িত্বভার গ্রহণ করে সবক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনি। মানুষের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরে আসে।”
একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে অন্যটি বাস্তবায়নের কাজ শুরুর কথা জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল।”
জিডিপির ভিত্তিতে বিশ্বে বাংলাদেশের ৪৫তম এবং ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে ৩৩তম স্থানে উঠে আসাকে উন্নয়নের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি।
সামাজিক উন্নয়নের অন্যান্য সূচকে উন্নতির চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের এক ঐতিহাসিক দিকসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আসুন, দল-মত ও বিভক্তির ঊর্ধ্বে উঠে এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখি।”
২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করেছিল শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার। ইতোমধ্যেই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উঠে এসেছে।
তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখার প্রত্যয় জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আশাবাদী এবং আত্মবিশ্বাসী দেশবাসীকে সাথে নিয়ে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশে পরিণত করব।”
উন্নয়নের ফিরিস্তি
ডিজিটাল বাংলাদেশ: ৭ বছরে নিরলস প্রচেষ্টায় আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ২০০ ধরনের ডিজিটাল সেবা দেওয়া হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের মাসিক আয় ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। গত অর্থবছরে আইটি এবং আইটিএস খাত থেকে আয় ৪০০ মিলিয়ন ডলার।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ওয়াই-ফাই-এর মাধ্যমে বিনামূল্যে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া শুরু হয়েছে। ২৫ হাজার ওয়েবসাইট নিয়ে চালু হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েব পোর্টাল ‘তথ্য বাতায়ন’। ৮ হাজার পোস্ট অফিসকে ডিজিটাল সেন্টারে রূপান্তরের কাজ এগিয়ে চলছে।
গাজীপুর ও যশোরে হাই-টেক পার্ক এবং বিভাগীয় শহরে সিলিকন সিটি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপনের পরিকল্পনা হয়েছে।
ফোর জি শিগগিরই: ইন্টারনেট ব্যবহারে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। থ্রি জি সেবা চালু করা হয়েছে। শিগগিরই ফোর জি চালু করা হবে। এখন মোবাইল সিম গ্রাহকের সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি। ইন্টারনেট গ্রাহক ৫ কোটি ৭ লাখ ৭ হাজারের বেশি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র- স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রবৃদ্ধি ছাড়াবে ৭%: গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এর আগের ৫ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। অচিরেই প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ।
চলতি ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৩১৪ মার্কিন ডলার।
দারিদ্র্যের হার ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে ২২ দশমিক ৪ শতাংশে এসেছে। ২০০৬ সালে থাকা অতিদারিদ্র্যের হার ২৪.২ শতাংশ এখন ৭.৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
সরকারি ও বেসরকারিভাবে দেড় কোটি মানুষের চাকরি হয়েছে। ৩৫ লাখ ৭৫ হাজার ৩৪৮ কর্মীর বিদেশে গেছে কাজ নিয়ে। রেমিটেন্স ১৫.২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। রপ্তানি আয় বেড়ে হয়েছে ৩২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বেড়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ: বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা ১৪ হাজার ৭৭ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। ১২ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। ৪৪ লাখ সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর লক্ষ্য। গ্যাস উৎপাদন দৈনিক ২ হাজার ৭২৮ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়েছে।
যোগাযোগে মহাযজ্ঞ: হাতিরঝিল প্রকল্পসহ গত ৭ বছরে ছয়টি উড়াল সেতু নির্মিত হয়েছে। ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ চলমান। ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ সড়ক চার লেইনে উন্নীত করার কাজ শেষের পথে। ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ শেষ করার আশা। এই সেতু ঘিরে মাওয়া, শিবচর ও জাজিরাকে ঘিরে আধুনিক স্যাটেলাইট শহর গড়ার পরিকল্পনা।
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, নারায়ণগঞ্জের ৩য় শীতলক্ষ্যা সেতু, দ্বিতীয় কাঁচপুর, দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় গোমতী সেতুর নির্মাণ এবং এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ‘বাস র্যাপিড ট্রানজিট’ নির্মাণের মূল কাজ অচিরেই শুরুর আশা।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা: ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৪ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য-শস্য উৎপাদন। চাহিদা মিটিয়ে চাল এখন রপ্তানি। মৎস্য উৎপাদন বেড়ে ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ।
শিক্ষার হার ৭১%: শিক্ষার হার ৭১ শতাংশ। সাত বছরে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে ১৯২ কোটি বই বিতরণ। ১ কোটি ২১ লাখ ৭৮ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি ও উপ-বৃত্তি আওতায় আনা। ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ এবং ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণ। প্রতিটি জেলায় একটি করে সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি। ৩ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১৭২টি কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন। ২৩ হাজার ৩৩১টি মাধ্যমিক স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন।
স্বাস্থ্যসেবা দোরগোড়ায়: সাড়ে ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে গ্রামের মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। মানুষ বিনামূল্যে ৩২ ধরনের ওধুধ পাচ্ছে সেখানে। সাড়ে ১২ হাজারের বেশি চিকিৎসক, ১৩ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ। আরও ১০ হাজার নার্স নিয়োগের প্রতিশ্রুতি। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা ১ লাখ পরিবারের মধ্যে স্বাস্থ্য কার্ড বিতরণের আশ্বাস।
লিঙ্গ সমতা: লিঙ্গ সমতায় দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষস্থান। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু। মাতৃত্বকালীন ছুটি ৪ মাস থেকে বাড়িয়ে ৬ মাস করা। ৪০টি মন্ত্রণালয়ে ‘জেন্ডার সেনসিটিভ’ বাজেট। হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি।
বেতন-ভাতা বৃদ্ধি:সরকারি কর্মচারীদের অবসরের বয়স বাড়ানো পাশাপাশি বেতন ১২৩ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন বাড়িয়ে ৫ হাজার ৩০০ টাকায় উন্নীত। ৮ হাজার ৫০৭ টি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারকে ভাতা। প্রায় ৪৭ লাখ ১৩ হাজার মানুষ বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত ও প্রতিবন্ধীকে ভাতা।
‘গণতন্ত্র দিয়েছে আওয়ামী লীগ’
বাংলাদেশ বর্তমানে ‘গণতন্ত্রহীন’ অবস্থায় রয়েছে বলে বিএনপির সমালোচনার প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা বলেন, “আওয়ামী লীগ দেশকে স্বাধীনতা দিয়েছে, গণতন্ত্র দিয়েছে। যখনই সরকার গঠন করেছে, দেশের উন্নয়ন করেছে।”
বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির দোসরদের দায়ী করেন তিনি।
“গণতন্ত্র ও উন্নয়ন বিএনপি-জামাত নেতৃত্ব সহ্য করতে পারে না। মানুষ শান্তিতে থাকবে, হাসি মুখে জীবনযাপন করবে তা ওদের সহ্য হয় না।”
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী সবার বিচার নিশ্চিত করতে সরকারের অবস্থানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি, রায় কার্যকর করা হচ্ছে, কেউই বিচার বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।”
ভারতের সঙ্গে স্থলসীমানা চুক্তি বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আলোচনার মাধ্যমে আমরা ভারতের সাথে স্থলসীমানা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করেছি। ছিটমহল বিনিময়ে ১০ হাজার ৫০ একর জমি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যোগ হয়েছে।”
[এই প্রতিবেদন যৌথভাবে করেছেন সুমন মাহবুব, শহীদুল ইসলাম ও সুলাইমান নিলয়]