1. [email protected] : Staff Reporter : Staff Reporter
বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:২৭ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ খবরঃ
২০২৫ সালের শেষে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে: প্রধান উপদেষ্টা বিজয় দিবসে ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিজয় কেতন উড়াল বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস লেখা হয়নি: বদরুদ্দীন উমর গুম-খুনের অভিযোগে ক্ষমা চেয়ে আয়নাঘরের কথা স্বীকার করলেন র‍্যাব ডিজি ঐক্যের ডাক হাসনাত আব্দুল্লাহর দেশের জন্য ক্ষতিকর চুক্তি বাতিলের দাবি করা হয়েছে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য চলমান অপচেষ্টা নতুন বাংলাদেশের যাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে: প্রধান উপদেষ্টা কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন সাবেক এসপি বাবুল আক্তার রমেন রায়ের ওপর হামলার ঘটনাটি পুরোনো, তিনি চিন্ময়ের আইনজীবী নন

আমরা জানতে চাই – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

  • আপডেটের সময় : বৃহস্পতিবার, ৯ আগস্ট, ২০১৮

সংবাদ মাধ্যমে সেদিন আলোকচিত্র শিল্পী শহিদুল আলমের একটি ছবি ছাপা হয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে অনেক পুলিশ মিলে শহিদুল আলমকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার চেহারা বিপর্যস্ত এবং খালি পা। ছবিটি দেখে আমার বুকটা ধক করে উঠেছে। কারণ আমার মনে হয়েছে, এই ছবিটি আমারও হতে পারতো। শহিদুল আলম যেসব কাজ করেন, আমরাও আমাদের মতো করে সেসব করতে চাই, তার মতো প্রতিভাবান বা দক্ষ নয় বলে করতে পারি না। কখন আমাদের কোন কাজ বা কোন কথা আপত্তিকর মনে হবে না এবং একই ভঙ্গিতে আমাদের গায়ে হাত দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নেওয়া হবে না সেটি কে বলতে পারে? কিছুদিন আগে আমি ছুরিকাহত হওয়ার পর আমার রক্তাক্ত অর্ধচেতন ছবি খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল। সেই ছবি দেখে আমার আপনজন যতটুকু বিচলিত হয়েছিল, আমি নিশ্চিত তারা যদি দেখতো একদল পুলিশ আমাকে আঘাত করে খালি পায়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, তারা তার চাইতেও একশ গুণ বেশি বিচলিত হতো। এই মুহূর্তে শুধু শহিদুল আলমের পরিবারের লোকজন নয়, আমরাও অনেক বিচলিত।

আলোকচিত্রশিল্পী শহিদুল আলমের অপরাধটি কী আমি সেটা বুঝতে পারিনি। তিনি আল জাজিরাতে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। আমি সেটা দেখিনি, তবে বিবিসির খবরে পড়েছি, তিনি আন্দোলন দমনের ব্যাপারে সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন। (আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে কখনও বিদেশি সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দেই না, ওয়াল স্ট্রীট জার্নালের একদল সাংবাদিক আমি ছুরিকাহত হওয়ার পর আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। এই মুহূর্তে ‘টাইম’ এর একজন সাংবাদিক আমাকে ই-মেইল পাঠিয়েছেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে তাদের বলি, বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমা সাংবাদিকদের একধরনের নেতিবাচক ধারণা আছে এবং আমি যেটাই বলি না কেন, আমাদের দেশের নেতিবাচক রূপটা দেখানোর জন্যে সেটা ব্যবহার করা হবে। তাই আমি তাদের থেকে দূরে থাকি।) কিন্তু শহিদুল আলমের মতো একজন আন্তর্জাতিক মানুষ, একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ, দেশের অবস্থাটি বিদেশি সাংবাদিককে বলতেই পারেন। সেটি যদি সরকারের সমালোচনা হয়, সরকারকে সেটা মেনে নিতে হবে। কিছুতেই সেটাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।

তার দ্বিতীয় অপরাধ হিসেবে ফেসবুক লাইভে তার বক্তব্যের কথা শুনতে পাচ্ছি। ফেসবুক লাইভ বিষয়টি কী, আমি সেটা সঠিক জানি না। সেখানে তিনি কী বলেছেন, সেটাও আমি জানি না, কিন্তু যেটাই বলে থাকেন, সেটা তার বক্তব্য। এই বক্তব্য দিয়ে তিনি বিশাল যড়যন্ত্র করে ফেলছেন, সেটি তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। আপত্তিকর কিছু বলে থাকলে, কেন সেটি বলেছেন, সেটি নিয়ে গবেষণা হতে পারে, আলোচনা হতে পারে, তার চাইতে বেশি কিছু তো হওয়ার কথা নয়। আমি শুনেছি, তার থেকেও অনেক বেশি আপত্তিকর বক্তব্য দেওয়ার পরেও অভিনয় শিল্পীর অনেকে পার পেয়ে গেছেন। তাহলে খ্যাতিমান সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই আলোকচিত্রশিল্পীর ওপরে এই আক্রমণ কেন? যদি সত্যিই তিনি ষড়যন্ত্র করে থাকেন, আমরা সেটি জানতে চাই।

একজন মানুষ তার সারাজীবনের কাজ দিয়ে একটা পর্যায়ে পৌঁছান। আমরা তখন তাকে একটা শ্রদ্ধার আসনে বসাই। তাকে সম্মান দেখিয়ে আমরা নিজেরা সম্মানিত হই। তখন যদি তাকে অসম্মানিত হতে দেখি, আমরা অসম্ভব বিচিলিত হই। শহিদুল আলম যেটাই বলে থাকুন, সরকারের সেই কথাটি শোনা উচিত ছিল। কোনোভাবেই সেটাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত হয়নি। আমরা কি সংবাদ মাধ্যমে সাংবাদিকদের গায়ে হাত তুলতে দেখিনি? তাদের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতে দেখিনি? সেগুলো কী অপরাধ নয়? কোনও কোনও অপরাধ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য কিছুকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হলে এই দেশের মূল ভিত্তিটা ধরেই কি আমরা টান দেই না?

স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা মিলে অসম্ভব সুন্দর একটা আন্দোলন শুরু করেছিল। কেউ মানুক আর নাই মানুক, পৃথিবীর ইতিহাসে এটা একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে। আমরা সারাজীবন চেষ্টা করে রাস্তাঘাটে মানুষের জীবনের নিরাপত্তার যে বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারিনি, তারা সেগুলো আমাদের উপহার দিয়েছে। কিন্তু এই আন্দোলনের শুরু থেকে আমার ভেতরে একটা দুর্ভাবনা কাজ করেছিল। সহজ সরল কমবয়সী ছেলেমেয়েরা যে বিশাল একটা আন্দোলন গড়ে তুলেছে, তারা কি সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? আমরা সবাই জানি, সেই সহজ সরল আন্দোলনটি শুধু যে জটিল হয়ে উঠেছিল তা নয়, ভয়ঙ্কর রূপও নিতে শুরু করেছিল। ঝিগাতলার সেই সংঘর্ষে কারা অংশ নিয়েছিল? স্কুলের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই ঘণ্টার পর ঘণ্টা মারামারি করেনি। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের আন্দোলনে কেন বড়রা মারামারি করতে এসেছে? তারা কারা? এক পক্ষ ছাত্রলীগ, সরকার সমর্থক কিংবা পুলিশ হতে পারে, অন্যপক্ষ কারা? আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শীকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনিও উত্তর দিতে পারেননি।

আমি অস্বীকার করছি না যে আজকাল মিথ্যা সংবাদ এবং গুজবের কোনও শেষ নেই। কয়েকদিন আগে আমার মৃত্যু সংবাদ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা যখন নিজেদের ‘আমি রাজাকার’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল, তখন আমি আমার প্রবল বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেছিলাম। প্রফেসর আনিসুজ্জামানের সাম্প্রতিক একটা লেখা থেকে জানতে পারলাম, তার মর্মাহত হওয়ার হওয়ার মতো এই খবরটি তিনি আমার লেখা থেকে জানতে পেরেছিলেন। তাকে কেন এই তথ্যটি আমার লেখা থেকে জানতে হলো? দেশের এত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রের কোনোটি কেন এই তথ্যটি প্রকাশ করালো না? তাদের কারও কি মুক্তিযুদ্ধের জন্যে দায়বদ্ধতা নেই? রাজাকারের জন্যে ঘৃণা নেই? যাই হোক রাজাকারের জন্যে আমার ঘৃণা প্রকাশ করার পর কোটা সংস্কার প্রজন্মের প্রায় সবাই আমার মৃত্যু কামনা করছে। তাই আমার মৃত্যু সংবাদ প্রচার করাটি হয়তো স্বাভাবিক ব্যাপার কিন্তু অসংখ্য মিথ্যা সংবাদ ও গুজব প্রচার করা তত স্বাভাবিক নয়। সরকার যেভাবে তথ্যগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে এবং আন্দোলন দমন করার জন্য যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেগুলো কিন্তু অনেকের ভেতরেই এক ধরনের ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। সরকার কী এটি জানে? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ক্ষমা করে দিলে কী এমন ক্ষতি হতো? ছাত্রলীগের ছেলেরা কি অনেকক্ষেত্রে তাদের থেকেও বড় অপরাধ করেনি?

যাই হোক, আগস্ট মাস বাংলাদেশের জন্য একটি অশুভ মাস। কেউ বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, এই মাসটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি এক ধরনের অশান্তিতে থাকি।

এই বছর আমার অশান্তিটা বেশি। আমি যখনই চিন্তা করছি আলোকচিত্রশিল্পী শহিদুল আলমকে শুধু গ্রেফতার করা হয়নি, তাকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে, আমি বিষয়টি ভুলতে পারছি না।

শেষবার সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমাদের অনেক শিক্ষককে ধরে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। মনে আছে, আমরা তখন আমাদের সহকর্মীদের জন্যে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করছি কিন্তু কেউ সেই লেখা ছাপানোর সাহস পাচ্ছে না। আমরা, শিক্ষকেরা তখন খুব অসহায় বোধ করেছিলাম।

এখন অনেক দিন পর আবার কেমন যেন অসহায় বোধ করছি। নিজ দেশে কেন আমরা অসহায় অনুভব করবো? কী হচ্ছে, আমরা কী জানতে চাইতে পারি?

এই পোস্টটি আপনার সামাজিক মিডিয়াতে শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | সকালেরফেনি.কম
Design & Developed BY HostingNibo